চট্টগ্রাম মেডিকেলে চারগুণ বেশি রোগী মারা যাচ্ছে ‘উপসর্গ’ নিয়ে, বেশিরভাগই আদতে করোনা
রেড জোনের চেয়ে ইয়েলোতে মৃত্যু চারগুণ বেশি
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ‘রেড জোনে’র চেয়েও উপসর্গধারী রোগীর জন্য নির্দিষ্ট ‘ইয়েলো জোনে’ রোগী মারা যাচ্ছে অনেক বেশি। গত রোববার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত এই হাসপাতালের ‘রেড জোন’ বা আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগী মারা গেছেন ৪০৬ জন। অন্যদিকে একই সময়ে চালু হওয়া ‘ইয়েলো জোনে’ এ পর্যন্ত রোগী মারা গেছেন ১ হাজার ৫৩২ জন। অর্থাৎ রেড জোনের তুলনায় ইয়েলো জোনে ‘করোনার উপসর্গ’ নিয়ে মারা গেছেন প্রায় চারগুণ বেশি রোগী।
অথচ দেখা গেছে, ‘রেড জোনে’ হওয়া মৃত্যুগুলোর হিসাব গোণায় ধরা হলেও ‘ইয়েলো জোনে’ ঘটা মৃত্যুর হিসাব গোণাতেই ধরা হচ্ছে না। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম জেলার করোনায় মৃতদের যে হিসাব দেওয়া হয়, সেখানে স্থান পাচ্ছে শুধু ‘রেড জোন’ থেকে পাওয়া মৃত্যুর হিসাবই। অথচ করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত চিকিৎসক ছাড়াও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের অনেকে একে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে অভিহিত করে বলছেন, উপসর্গের রোগীদের বেশিরভাগই প্রকৃতপক্ষে মারা যাচ্ছেন করোনাতেই।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য জোন রয়েছে দুটি। এর মধ্যে করোনা শনাক্তদের সরাসরি ভর্তি করা হয় ‘রেড জোনে’। আর পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের রাখা হয় ‘ইয়েলো জোনে’। দুই জোনেই প্রতিদিন মারা যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী। চমেক হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে রেড জোন ও ইয়েলো জোনের রোগী ভর্তির হিসেব টাঙ্গানো আছে। কিন্তু সেখানে রেডজোনের মৃত্যুর হিসাব থাকলেও ইয়েলো জোনে রোগী মৃত্যুর কোনো তথ্য রাখা হয় না।
রোগী যেভাবে ভাগ হয় রেড ও ইয়েলোতে
জানা গেছে, জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে গেলে তাকে প্রথমে র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করা হয়। পরীক্ষা শেষে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে পাওয়া ফলাফলে যদি কারও শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, তাহলে তাকে রেড জোন বা আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চমেক হাসপাতালে বর্তমানে করোনা চিকিৎসায় ‘রেড জোন’ রয়েছে দুটি। ‘ইয়েলো জোন’ আছে একটি। অন্যদিকে র্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষায় সাধারণ জ্বর ও সর্দি-কাশি নিয়ে আসা কোনো রোগীর ফলাফল যদি নেগেটিভ আসে তাহলে তাকে ‘ফ্লু কর্নারে’ পাঠানো হয়।
এর বাইরে যেসব রোগীর জ্বর ও সর্দির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট এবং এক্সরে রিপোর্টে বুকের দুই পাশে আস্তরণ দেখা যায়, তাদেরকে এন্টিজেন পরীক্ষায় নেগেটিভ হলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় অবজারভেশনে অর্থাৎ ‘ইয়েলো জোনে’। এরপর ওই রোগীদের আরটিপিসিআর বা নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসলে রোগীকে রেড জোনে পাঠানো হয়। তবে এই নমুনা পরীক্ষার ফলাফল আসতে সময় লেগে যায় দুই থেকে তিন দিন, এর মধ্যেই অনেক রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, আরটিপিসিআর মেশিনের নমুনা পরীক্ষায় ৬৯ শতাংশ সেনিসিটিভিটি টেস্ট এবং বাকি ৩১ শতাংশ ফলস নেগেটিভ। এর অর্থ এটাই দাঁড়ায়, ৩১ শতাংশ যে নেগেটিভ আসে সেটি ভুলও হতে পারে। করোনা শনাক্তের নিশ্চিত ফলাফল জানতে দরকার পড়ে সিটি স্ক্যান। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চমেক হাসপাতালের অবজারভেশন ওয়ার্ড বা ‘ইয়েলো জোনে’ যেসব রোগী ভর্তি হন— পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই তাদের অনেকের মৃত্যু ঘটে। ‘ইয়েলো জোন’ চালু হওয়ার পর থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত ওই জোনে রোগী মারা গেছেন ১ হাজার ৫৩২ জন। অন্যদিকে একই দিনে চালু হওয়া ‘রেড জোন’ বা আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগী মারা গেছেন ৪০৬ জন। অর্থাৎ রেড জোনের তুলনায় ইয়েলো জোনে ‘করোনার উপসর্গ’ নিয়ে মারা গেছেন প্রায় চারগুণ বেশি রোগী।
ইয়েলো জোনের হিসাবনিকাশ
চালু হওয়ার পর থেকে গত রোববার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত চমেক হাসপাতালের অবজারভেশন ওয়ার্ড বা ‘ইয়েলো জোনে’ ভর্তি হয়েছেন মোট ৮ হাজার ৩৭২ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৫৩২ জন।
চমেক হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গত মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) ‘ইয়েলো জোনে’ ভর্তি হন ৪৫ জন রোগী। ওই দিন সেখানে মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ১১৯ জন। ওইদিন জোনটিতে রোগী মারা গেলেন ৬ জন। ২৬ জুলাই (সোমবার) রোগী ভর্তি হন ৩৫ জন এবং ওইদিন মারা গেছেন ৮ জন। রোববার (২৫ জুলাই) রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩১ জন। এই সময়ে সেখানে রোগী মারা গেছেন সাতজন।
শনিবার (২৪ জুলাই) রোগী আসে ৩৪ জন। ওই ২৪ ঘন্টায় সেখানে মারা যান ৮ জন। একইভাবে ২৩ জুলাই ভর্তি হন ৪৪ জন। ওইদিন সেখানে মৃত্যু ঘটে ১২ জনের। ২২ জুলাই রোগী ভর্তি ছিলেন ২৫ জন। ওইদিন মৃত্যু হয় ৮ জনের। ২১ জুলাই ভর্তি হন ৩৭ জন। ওইদিন সেখানে মৃত্যু হয় ১০ জনের।
‘ইয়েলো জোনে’ ২০ জুলাই ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৬ জন। ওইদিন সেখানে মৃত্যুবরণ করেন ৪ জন। ১৯ জুলাই রোগী ভর্তি ছিল ৩৮ জন। ওইদিন সেখানে মৃত্যু ঘটে ৫ জনের। ১৮ জুলাই ভর্তি হন ৩১ জন রোগী। ওইদিন সেখানে মৃত্যুবরণ করেন ৪ জন। ১৬ জুলাই ভর্তি ছিলেন ৩১ জন এবং ওইদিন মৃত্যু হয় ৭ জনের। ১৪ জুলাই রোগী ভর্তি ছিলেন ২৯ জন আর মৃত্যু একজনের। ১০ জুলাই রোগী ভর্তি হন ২২ জন এবং ওইদিন মারা যান ৭ জন। ৪ জুলাই ভর্তি হয়েছিলেন ১৮ জন এবং ওইদিন মারা যান ৫ জন।
রেড জোনের হিসাবনিকাশ
এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‘রেড জোনে’ সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত মোট রোগী ভর্তি ছিলেন ১৭৮ জন। শুধু ওইদিনই সেখানে নতুন রোগী ভর্তি হন ৪১ জন। ওইদিনই আবার রেড জোনে রোগী মারা যান ৯ জন। সোমবার (২৬ জুলাই) রেডজোনে ভর্তি হন ৩৮ জন এবং ওইদিন মারা গেছেন ১১ জন। রোববার (২৫ জুলাই) রেড জোনে মারা গেছেন ৫ জন, ২৪ জুলাই মারা যান ৬ জন। ২৩ জুন ৫৩ জন রোগী ভর্তি হন এবং ওইদিন মারা যান ৫ জন। ২২ জুলাই ভর্তি হন ২৫ জন এবং ওইদিন মারা গেছেন ৮ জন। ২১ জুলাই ৪০ জন ভর্তি হন এবং মারা যান ৯ জন।
ইয়েলো জোনে কেন এতো মৃত্যু?
রেডজোনের চেয়েও তুলনামূলক কম ঝুঁকির ‘ইয়েলো জোনে’ মৃত্যুর হার কেন এতো বেশি— এ প্রশ্নে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বিভাগীয় সমন্বয়ক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম মিনহাজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইয়েলো জোনে রোগীর মৃত্যুহার উদ্বেগজনক। কিন্তু জনসমক্ষে সেটা অপ্রকাশিত থেকে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এই জোনে রোগীর চাপ ও মৃত্যুহার আনুপাতিক হারে বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘চমেক হাসপাতালের ইয়েলো জোনে উপজেলা থেকে একেবারে অন্তিম সময়ে এসে নেগেটিভ হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। আবার কোভিড পরবর্তী জটিলতা নিয়েও অনেক রোগী ভর্তি হন। উপসর্গের ১২ থেকে ১৪ দিন পরে এসে ভর্তি হওয়ার কারণে তাদের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ফলে তারা ইয়েলো জোনেই থেকে যান এবং কোভিড জটিলতায় ভুগে নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করেন।’
ডা. মিনহাজ বলেন, ‘এখানে হৃদরোগে আক্রান্ত কিন্তু করোনার উপসর্গ আছে— এমন অনেক রোগীকেও ভর্তি করানো হয়। যেসব রোগীর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হয়তো সেভাবে প্রদান করা সম্ভব হয় না যেভাবে হৃদরোগ বিভাগে সম্ভব হতো। তাই এ ধরনের রোগীও মৃত্যুবরণ করছেন। এই জোনে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা পৃথকভাবে ‘করোনা উপসর্গ প্রসূত মৃত্যু’ হিসাবে প্রকাশ করা যেতে পারে। এতে এ জোনের প্রতি সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়বে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও করোনা ইউনিটের সমন্বয়কারী (ফোকাল পার্সন) ডা. মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের হিসেবে রেড জোনের মৃত্যুটাকেই ফোকাস করি। রেড জোনের মৃত্যুর হিসাব আমরা সিভিল সার্জন অফিসে পাঠাই। এটা শুরু থেকেই হয়ে আসছে।’
সিপি